শনিবার, ২৮ Jun ২০২৫, ০৫:৩১ পূর্বাহ্ন
আবদুল আজিজ:
মহেশখালীতে নিজের বসতভিটার জমি রক্ষায় সিসি ক্যামরা বসিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি অসহায় রওশন আলীর। রাতের আধাঁরে স্থানীয় প্রভাবশালী ও ভূমিগ্রাসী চক্র হামলা চালিয়ে বসতবাড়ি ভাংচুর, লুটপাট ও ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। আকস্মিক ঘর ভেঙ্গে দেয়ায় কোন উপায় না পেয়ে ত্রিপল টাঙ্গিয়ে খোলা আকাশের নিচে দিনাতিপাত করছেন রওশন আলীর পরিবার। এ নিয়ে মহেশখালী থানায় রওশন আলী বাদি হয়ে একটি অভিযোগ দায়ের করলেও পুলিশ প্রভাবশালীদের ইন্ধনে মামলা নেয়নি। পরে ১০জনকে আসামী করে আদালতে মামলা করেছেন রওশন আলী। মামলাটি কক্সবাজার ‘পিবিআই’কে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
মামলার এজাহার ও স্থানীয় সূত্র জানান, গত ১১ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা মহেশখালী পৌরসভার উত্তর ঘোনারপাড়া গ্রামের হাজী মিয়া হোসনের পুত্র রওশন আলী হাসানের বসতবাড়ি দখলে নিতে মহেশখালী গোরকঘাটা সিকদার পাড়া এলাকার হাশেম সিকদারের পুত্র কায়সার সিকদারের নেতৃত্বে ১৫/২০ জনের একটি সংঘবদ্ধ দল হামলা চালায়। রাতের আঁধারে অস্ত্র, দা, কিরিচ নিয়ে রওশন আলীর মালিকানাধীন বসতবাড়ি ও ভিটায় অবৈধভাবে দখলের উদ্দেশ্যে ভাংচুর করে। এ সময় হামলাকারীরা একাধিক ফাকা গুলি বর্ষণ করে ত্রাস সৃষ্টি মাধ্যেমে রওশন আলীর স্ত্রী পুত্র ও কন্যাদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে অস্ত্রধারীরা বসত ভিটার চারপাশে স্থাপিত সিসি ক্যামেরা ও এনভিআর, সুইস সহ সকল সরাঞ্জজাম লুটপাট করে ঘেরা বেড়া ভাংচুর করে। এসময় রওশন আলী স্ত্রী রহিমা আক্তার বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করলে হামলাকারীরা রহিমা আক্তার তার স্কুল পড়ুয়া মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকা, ফুফু বেগম খাতুন ও ভগ্নিপতি আব্দুল আজিজ কে মারধর করে। ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে লুঠপাট করা মালামাল নিয়ে যাওয়ার সময় প্রাণ নাশের হুমকি দেয়। ভুক্তভোগী রওশন আলী জানমাল রক্ষার্থে ৯৯৯ কল দিলে দ্রুত সময়ে মধ্যে থানা পুলিশ উপস্থিত হয়ে উক্ত ঘটনা সরেজমিনে পরিদর্শন করে। এলাকাবাসী এগিয়ে এসে আহতদের উদ্ধার করে মহেশখালী হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে উক্ত ঘটনায় জমির মালিক রওশন আলী বাদী হয়ে মহেশখালী থানায় একটি এজাহার দায়ের করলেও প্রভাবশালীদের চাপের মুখে মামলা নিতে অপারগতা প্রকাশ করে পুলিশ। এতে নিরাপত্তাহীনতায় থাকা রওশন আলীর পরিবার নিরুপায় হয়ে কায়সার সিকদারকে প্রধান আসমী করে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ১০ জনের বিরুদ্ধে মহেশখালী সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করেন। পরে আদালতের বিচারক বাদী পক্ষের আইনজীবির বক্তব্য শুনানীর শেষে ঘটনাটি আমলে নিয়ে পিবিআই কক্সবাজারকে তদন্তের জন্য নির্দেশ দেয়।
মহেশখালীতে ভুমি রক্ষায় সিসি ক্যামরা, খোলা আকাশের নিচে রওশনের পরিবার-ছবি: কক্সবাজার ভয়েস ডট কম।
মহেশখালীতে ভুমি রক্ষায় সিসি ক্যামরা, খোলা আকাশের নিচে রওশনের পরিবার-ছবি: কক্সবাজার ভয়েস ডট কম।
ঘটনাস্থল সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা যায়, উক্ত সংগঠিত ঘটনায় বসতভিটার আঙ্গিনার এক পাশে খোলা আকাশের নিচে স্কুল পড়–য়া সন্তানদের নিয়ে বসে আছেন রওশন আলী হাসান ও তার স্ত্রী রহিমা আক্তার। চোখে মুখে আতংকের চাপ। ভীতসন্তুষ্ট স্কুল পড়–য়া সন্তানরা কাঁদছে ভিটে হারানোর ভয়ে। দ্বিতীয় হামলার ভয়ে আতংক ও উৎকণ্ঠায় রওশন আলী ও তার স্ত্রী রহিমা আক্তার।
খোলা আকাশের নিচে বসা রওশন আলীর স্ত্রী রহিমা আক্তার কক্সবাজার ভয়েসকে জানান, ‘দ্বীপ উপজেলায় এখন জমির দাম বেড়েছে। আমার স্বামীর জমিটির মুল্য আকাশচুম্বী হওয়ায় মহেশখালী উপজেলার গোরকঘাটা এলাকার হাশেম সিকদারের পুত্র কায়সার সিকদারের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে। প্রথমে বিক্রির জন্য চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু, আমাদের একমাত্র সহায় সম্বল বসতভিটা বিক্রি করবে না বলে জানালে রাতের আঁধারে দখলের জন্য হামলা করে। এসময় বাড়িঘর ও ভিটার সীমানা প্রাচীর ভাংচুর করে এবং লুঠপাট চালায়। ফাঁকা গুলি করে ভীতি সঞ্চার করে। এরপর থেকে আতংক ও ভয়ে আমার স্কুল পড়–য়া ছেলে/মেয়েরা কাঁদছে।’
ভুক্তভোগী রওশন আলী হাসান কক্সবাজার ভয়েসকে জানান, ‘ মহেশখালী উপজেলার গোরকঘাটা মৌজার ২৪৫২-৬২ খতিয়ানের ৬০ শতক জমি ক্রয় সুত্রে মালিক হয়। জমিটির বিক্রি করতে বার বার চাপ দেয় স্থানীয় প্রভাবশালী ভুমিগ্রাসী চক্র কায়সার সিকদার। বিক্রি না করলে জোরপূর্বক দখল করবে বলে হুমকি দেয়। ফলে আমি আমার বসতভিটা রক্ষায় বাড়িতে সিসি ক্যামরা স্থাপন করি। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে রাতের আঁধারে বসতভিটা দখলে নিতে হামলা চালায়। এসময় একের পর এক যখন ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে, তখন ৯৯৯ নাম্বারে কল দিলে ঘটনাস্থলে পুলিশ আসে এবং আমরা জানে রক্ষা পায়। কিন্তুু, পরের দিন সকালে পুলিশ আমাদের মামলাটি গ্রহণ করেনি। পুলিশ বলছে উপর মহলের চাপ রয়েছে। তাই মামলা নিতে অপরাগ। এরপর আদালতে মামলা করি। মামলা করায় ক্ষিপ্ত হয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে গোরকঘাটা বাজারে কায়সার বাহিনী আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান (লিয়াকত স্টোর) হামলা করে। বর্তমানে আমার পরিবার নিয়ে আমি আতংক ও উৎকন্ঠায় জীবনযাপন করছি। যে কোন সময় কায়সার সিকদাররা হামলা করতে পারে।’
মহেশখালীতে ভুমি রক্ষায় সিসি ক্যামরা, খোলা আকাশের নিচে রওশনের পরিবার-ছবি: কক্সবাজার ভয়েস ডট কম।
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় মোহাম্মদ হোসেন ও আব্দুল হাসেম কক্সবাজার ভয়েসকে জানান, ‘জমিটি রওশন আলী হাসানের। দীর্ঘদিন ধরে পরিবার নিয়ে সেখানে বসবাস করছে। স্থানীয় নজু মিয়ার ছেলে আব্দুল আজিজের সাথে জমি নিয়ে রওশন আলীর বিরোধের কথা শোনা গেলেও কায়সার সিকদারে কোন সত্ত্ব নেই। কায়সার সিকদার ও তার বাহিনী নিয়ে জমি দখলের চুক্তি করে আব্দুল আজিজের মেয়ে ওয়ারিশ নামধারি মাবিয়ার সঙ্গে। একারণে কায়সার সিকদার দখলবাজ হিসাবে ভাড়ায় হামলা করে রওশন আলীর বসতভিটায়। রাতে একাধিক গুলিবর্ষণের শব্দে এলাকাবাসি আতংক সৃষ্টি করে।’
এর আগে উক্ত ঘটনা মিমাংশার জন্য গঠিত ৪জন স্থানীয় শালিশকারদের মধ্যে একজন গোরকঘাটা ইউনিয়নের সাবেক চেয়াম্যান শামশুল আলম। তিনি কক্সবাজার ভয়েসকে জানান, ‘মহেশখালী পৌর মেয়র মকছুদ মিয়ার অনুরোধে আমরা ঘটনাস্থলে যায় এবং জমিটির কাগজপত্রাধি পর্যালোচনা করি। এতে দেখা যায় জমিটির মালিক পূর্বে বিক্রি করে দেয়ায় ওয়ারিশগণ কোন জমির অংশিদার থাকে না। একারণে জমিটির দখলস্বত্ত্ব ও জমির মালিকানা রওশন আলী হাসানের রয়েছে। সেখানে অভিযুক্ত কায়সার সিকদার ও তার পক্ষের কোন জমি নেই। বরং কায়সার সিকদার একটি বাহিনী গঠন করে জমিতে রাতের আঁধারে প্রবেশ করে এবং গোরকঘাটা বাজারে রওশন আলী পক্ষের লোকজনের উপর দফায় দফায় হামলা করছে। এতে কায়সার সিকদার প্রভাব বিস্তার করছে।’
মহেশখালীতে ভুমি রক্ষায় সিসি ক্যামরা, খোলা আকাশের নিচে রওশনের পরিবার-ছবি: কক্সবাজার ভয়েস ডট কম।
জমির ওয়ারিশ নামধারী মাবিয়া কক্সবাজার ভয়েসকে জানান, ‘এটি আমার পৈত্রিক সম্পত্তি। এ জমি আমাদের। এনিয়ে স্থানীয়ভাবে বিচার চলছে। কিন্তু, কারও বিচার মানছেন না রওশন আলী। আমরা কোনভাবে তার বসতবাড়ি হামলা করিনি। এটি একটি মিথ্যা মামলা করছে রওশন আলী।’
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত কায়সার সিকদার অভিযোগ অস্বীকার করে কক্সবাজার ভয়েসকে জানান, ‘রওশন আলীর বসতবাড়িতে আমি কেন হামলা করব? এখানে কি আমার কোন স্বত্ত্ব আছে? আমি উক্ত বিরোধপূর্ণ জমিটির স্থানীয় শালিশকারদের একজন। রওশন আলী কারও বিচার মানে না। থানায় নিজে অভিযোগ করে হাজির হয়নি। আবার পৌর মেয়র মকছুদ মিয়ার কাছেও অভিযোগ করে দুটি স্ট্যাম্প সই করে হাজির হচ্ছে না। বরং আদালতে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে। মামলাটি এখনও তদন্তাধিন। এছাড়াও স্থানীয় তহসীল অফিসের এ জমিটির ব্যাপারে ভুমি অফিসের তদন্ত চলছে।’
মহেশখালী ঘোরকঘাটার তহসীলদার মোহাম্মদ উল্লাহ কক্সবাজার ভয়েসকে জানান, ‘উক্ত জমিটি ভূমি অফিস থেকে আমার বরাবরে পাঠানোর পর পরিমাপ করে সার্ভেয়ার একটি প্রতিবেদন উপজেলা ভুমি অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছে। সেখানে কি রয়েছে আমার জানা নেই।’
মহেশখালী থানার ওসি মো: আব্দুল হাই কক্সবাজার ভয়েসকে জানান, ‘থানায় মামলা না নেয়ার অভিযোগটি সত্য নয়। এই রকম যদি কোন ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে অবশ্যই পুলিশ ব্যবস্থা নিবে। রওশন আলীর বিষয়টি এই মুহুর্তে মনে পড়ছে না। খোঁজ নিতে হবে।’
এব্যাপারে জানতে মহেশখালী পৌর মেয়র মকছুদ মিয়ার মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হয়। এতে তিনি মোবাইল রিসিভ করেনি। পরে ক্ষদে বার্তা পাঠিয়েও তার কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ভয়েস/আআ